
হেন্দ সালামা আবু হেলো,গাজা। ঈদুল আযহা আমাদের পরিবারের জন্য সবসময়ই ছিল পবিত্র একটি উৎসব।
এটি শুধু এক দিনের অনুষ্ঠান ছিল না, ছিল এক ঋতু—যা শুরু হতো অনেক আগেই।
উধহিয়াহ, অর্থাৎ কোরবানির পশু কেনা হতো মাসখানেক আগে। আমরা সেটিকে সন্তানের মতো যত্ন করতাম—খাওয়াতাম, তার গায়ে হাত বুলিয়ে দিতাম, তাকে আদর করতাম যেন সে আমাদের পরিবারেরই একজন।
ঈদের দিন যত ঘনিয়ে আসত, বাড়িতে ব্যস্ততাও ততই বাড়ত—ঘরদোর ঝাঁটপাঁছ, আসবাব পরিষ্কার, মিষ্টান্ন তৈরি, নতুন জামাকাপড় কেনা আর বিছিয়ে রাখা।
ঈদের তাকবীরের ধ্বনি আমাদের ঘর ভরিয়ে দিত, গলির ভেতর বেজে উঠত, আশপাশের পাড়া ছেয়ে যেত সেই সুরে।
আমরা ভাইবোনেরা ঘুমোতাম আমাদের নতুন জামাকাপড়ের পাশে। উত্তেজনায় ঘুমই হতো না—চুপিচুপি কথা বলতাম, হাসতাম, ভোর হবার অপেক্ষায় থাকতাম।
আমার বাবা আমাদের ঘুম থেকে তুলতেন ঈদের নামাজের জন্য, আর মা চুপিচুপি চলে যেতেন আমার শহীদ ভাইয়ের কবর জিয়ারতে—ফিসফিস করে বলতেন,
“জান্নাতে ঈদ মোবারক, আমার সোনা।”
আমরা পালা করে সেই উধহিয়াহর যত্ন নিতাম—জল দিতাম, গায়ে হাত বুলাতাম, ঘাস খাওয়াতাম, খেলতাম।
কোরবানির সময় এসে গেলে বাবা আমাকে বলতেন,
“চোখ বন্ধ করো।”
কারণ উধহিয়াহর রক্তপাত দেখা আমার পক্ষে সহ্য হতো না।
তবুও ছোটবেলা থেকেই আমি বুঝে গিয়েছিলাম—এ কেবল এক পশু জবাই নয়, এটি এক ধরনের সহমর্মিতা।
এটি ছিল সম্প্রীতি, উদারতা এবং গরিব-দুঃখীদের স্মরণ করার এক পবিত্র ক্ষণ।
যখন মাংস কাটা হতো, বাবা তিনভাগ করতেন—আত্মীয়, প্রতিবেশী ও গরিবদের জন্য।
সেদিনই আমি প্রথম উপলব্ধি করি, দেয়ার আনন্দ কত গভীর।
এরপর দুপুরে আমরা একসঙ্গে খেতাম—সাধারণত হালকা ভাজা মাংস।
ঐ দিনটা ছিল একেকটা আনন্দের ঢেউ—আত্মীয়স্বজন আসত, ঘরে হাসি-আনন্দে ভরে যেত, মিষ্টি বিতরণ হতো, সবাইকে ঈদের শুভেচ্ছা জানানো হতো।
সেই ছিল আমাদের ঈদ—প্রতিবছর।
কিন্তু এখন?
এটা প্রথম নয়, দ্বিতীয়ও নয়—চতুর্থ ঈদ, যেখানে আমাদের ওপর বোমা পড়ছে।
আমরা এখন উধহিয়াহ কোরবানি দিচ্ছি না—আমরাই কোরবানি হচ্ছি।
আমরা নতুন জামা পরে ঈদ করছি না—আমরা সেগুলোতেই দাফন হচ্ছি।
আমরা আমাদের সন্তানের হাত ধরে চলি না—আমরা তাদের কবর দিচ্ছি।
আমরা ভালোবাসায় প্রার্থনা করি না—আমরা ধ্বংসস্তূপে কাঁপতে কাঁপতে দোয়া করি।
আমরা অতিথি আপ্যায়ন করি না—আমরা তাবুতে আশ্রয় খুঁজি, যদি তাবু থাকেই এখনো।
আমরা আলিঙ্গন করি না—আমরা কবরের পাশে দাঁড়িয়ে থাকি, বুঝতে পারি না কোন কবরে প্রথমে যাব।
আমরা উধহিয়াহর মাংস ভাগ করি না—আমরা নিজেই না খেয়ে মরছি।
এই গণহত্যা শুধু আমাদের প্রাণ নেয়নি—ছিন্নভিন্ন করেছে আমাদের ধর্মীয় অনুভূতিও।
এ নিয়ে দ্বিতীয় বছর, আমরা কোরবানি দিতে পারছি না।
এক কেজি মাংস—যেটা ৭ অক্টোবরের আগে ছিল ছয় ডলার—এখন সেটা ১৫০ ডলার ছাড়িয়ে গেছে, যদি পাওয়া যায়।
খামার ধ্বংস, গবাদিপশু নেই, পোলট্রি খামার বন্ধ।
ইসরায়েল sacrificial পশুর প্রবেশও নিষিদ্ধ করেছে।
যে ক’টি গরু বেঁচে আছে, তাদের দাম ৫ হাজার ডলারের বেশি।
গাজার বহু পরিবার মাসের পর মাস কোনো মাংসই খায়নি।
আমরাও তাদের মধ্যে একজন।
শেষবার মাংস খেয়েছিলাম এক সংক্ষিপ্ত যুদ্ধবিরতির সময়।
২ মার্চ থেকে অবরোধ এমন জটিল হয়েছে যে, ক্যানজাত খাবারও এখন বিলাসিতা।
এই ঈদে আমরা বসেছিলাম শুধু এই প্রশ্নে—”একটুখানি খাওয়ার কি কিছু আছে, যা ঈদের অনুভূতি ফিরিয়ে আনতে পারে?”
আমার ছোট ভাইপো বাদার বলল,
“জমিয়ে রাখা ক্যানজাত মাংস হলেও দারুণ হতো।”
সে তখনও জানত না…
এখন আর ক্যানজাত খাবারও নেই।
দোকানের তাকগুলো খালি।
মানুষ না খেয়ে মরছে।
আমার মা বললেন,
“কিছু ছোলা খুঁজে আনব। ঈদের মতো লাগবে না ঠিকই, কিন্তু মানিয়ে নেবো।”
আমার আরেক ভাইপো আহমাদ—যে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে দুটি মুরগি পালন করছে—নীরবে বলল,
“আমার মুরগিগুলোকে কোরবানি ভাবো না। আমি যুদ্ধ শুরু থেকেই ওদের লালন করছি। ওরা আমার সাথে বাঁচবে।”
ঘরের ভেতর তখন যেন নিস্তব্ধতা নেমে এল।
সবকিছুর ভেতরেও, বাবা—যিনি জীবনে একবারও এই কোরবানি ছাড়েননি—বললেন,
“আল্লাহর শোকর, অন্তত কিছু খাবার তো জুটেছে।”
কিন্তু গাজার অন্যপ্রান্তে হাজার হাজার মানুষ কিছুই পায়নি।
যখন মুসলিম বিশ্ব চিন্তা করছে কী মাংস রান্না করবে এই ঈদে—গাজা লড়ছে নিঃশ্বাস ধরে রাখতে।
যখন পরিবারগুলো ঈদের রান্না নিয়ে ব্যস্ত—গাজার পরিবারগুলো ধ্বংসস্তূপ খুঁড়ছে।
যখন মুসলিমরা কোরবানি দেবে—গাজার মানুষ নিজেরাই সেই কোরবানি।