কাশ্মীর থেকে শুরু, দক্ষিণ এশিয়া জ্বলবে? ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনায় অশনি সঙ্কেত
কাশ্মীরের পেহেলগাম, যেখানে প্রকৃতি একসময় শান্তির বার্তা বয়ে আনত, আজ সেখানেই জঙ্গি হামলায় রক্ত ঝরেছে ২৬ জনের। অধিকাংশই নিরীহ বেসামরিক নাগরিক। এই হামলার প্রতিক্রিয়ায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সশস্ত্র বাহিনীকে ‘পূর্ণ স্বাধীনতা’ দিয়েছেন জবাব দিতে। এমন ঘোষণা একদিকে যেমন ভারতের কড়া অবস্থানের ইঙ্গিত দেয়, তেমনি গোটা দক্ষিণ এশিয়ার জন্য বয়ে আনতে পারে ভয়ানক অনিশ্চয়তা।
যে হামলা আবারও পুলওয়ামার স্মৃতি ফিরিয়ে আনল
২০১৯ সালের পুলওয়ামা হামলার ছায়া যেন আবার ফিরে এল। এবারও জড়িত পাকিস্তানভিত্তিক সংগঠন—‘দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট’, যা মূলত লস্কর-ই-তৈয়বারই সহায়ক সংগঠন। ফলে ভারতীয় জনমনে ক্ষোভ প্রবল এবং রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রতিশোধে অনড়।
মোদি বললেন, “এবার আর রেহাই নয়”
উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে মোদি বলেন, “সন্ত্রাসের ঘাঁটি এবার চিরতরে ধ্বংস করতেই হবে। ভারত আর আগের ভারত নয়—প্রতিটি ষড়যন্ত্রকারীর জবাব দেওয়া হবে।” স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল ও আরএসএস প্রধানের সঙ্গে ঘনঘন বৈঠক এই বার্তাই দেয়—পাল্টা ব্যবস্থা সময়ের অপেক্ষা মাত্র।
পাকিস্তান সরকারের প্রতিক্রিয়া
ভারতের প্রতিক্রিয়াশীল বক্তব্য ও সেনাবাহিনীকে ‘পূর্ণ স্বাধীনতা’ দেওয়ার ঘোষণার পর পাকিস্তান সরকার কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী খাজা মোহাম্মদ আসিফ সংবাদমাধ্যমে বলেন, “পরবর্তী কয়েকটি দিন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যে কোনো পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।” তিনি ভারতকে হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেন, “যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়া হলে পাকিস্তান এর উপযুক্ত জবাব দেবে। আমাদের সশস্ত্র বাহিনী সর্বোচ্চ সতর্কতায় রয়েছে।”
পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, ভারত উসকানিমূলক মনোভাব নিয়ে যে আচরণ করছে, তা শুধুই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। তারা আরও জানিয়েছে, কাশ্মীর ইস্যুতে ভারত বরাবরই আন্তর্জাতিক মনোযোগ ঘোরাতে সীমান্ত উত্তেজনা তৈরি করে থাকে।
এছাড়া পাকিস্তান আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে ভারতের ‘আক্রমণাত্মক ও দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ’ সম্পর্কে সতর্ক করেছে এবং দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তি বজায় রাখার জন্য জাতিসংঘ ও অন্যান্য গ্লোবাল স্টেকহোল্ডারদের হস্তক্ষেপ কামনা করেছে।
ভারত বনাম পাকিস্তান: সামরিক শক্তির তুলনা (Global Firepower Index ২০২৫ অনুযায়ী)
সামরিক শক্তির দিক দিয়ে ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। ভারত বর্তমানে সক্রিয় সৈন্য সংখ্যায় প্রায় ১৪ লক্ষ সেনা নিয়ে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ সামরিক শক্তি। অন্যদিকে, পাকিস্তানের সক্রিয় সেনা সংখ্যা প্রায় ৬.৫ লক্ষ। রিজার্ভ ফোর্সের দিক দিয়েও ভারত এগিয়ে—ভারতের রিজার্ভ সৈন্য প্রায় ১১.৫ লক্ষ, যেখানে পাকিস্তানের রয়েছে ৫.১ লক্ষ।
যুদ্ধক্ষেত্রের জন্য প্রয়োজনীয় ট্যাংক ব্যবস্থায় ভারত রয়েছে আরও শক্ত অবস্থানে। ভারতের ট্যাংক সংখ্যা প্রায় ৪,৬১৪, যেখানে পাকিস্তানের রয়েছে ৩,৭৪২। সাঁজোয়া যান বা আর্মার্ড ভেহিকল ব্যবস্থাতেও ভারত এগিয়ে—এর সংখ্যা ১০ হাজারের বেশি, পাকিস্তানের আছে প্রায় ৯ হাজার।
আকাশ প্রতিরক্ষা এবং আক্রমণে ভারতের বিমান শক্তি বেশি প্রভাবশালী। ভারতের মোট বিমান রয়েছে ২,২৭২টি, যার মধ্যে ৫৮৫টি যুদ্ধবিমান। পাকিস্তানের মোট বিমান ১,৩৭২টি, এর মধ্যে ৩৬৬টি যুদ্ধবিমান। হেলিকপ্টার ব্যবস্থায়ও ভারত এগিয়ে—৮০০টির বেশি হেলিকপ্টার রয়েছে ভারতের, যেখানে পাকিস্তানের আছে প্রায় ৩২০টি।
নৌবাহিনী দিক থেকে ভারতের ইউনিট সংখ্যা ২৯৫টির মতো, আর পাকিস্তানের তা ১০০-এর কিছু বেশি। যদিও উভয় দেশই পরমাণু অস্ত্রে সজ্জিত—ভারতের পারমাণবিক অস্ত্রের সংখ্যা আনুমানিক ১৬০ এবং পাকিস্তানের প্রায় ১৭০।
সামরিক বাজেটেও বিশাল ফারাক রয়েছে। ভারতের বার্ষিক প্রতিরক্ষা বাজেট ৭৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি, যেখানে পাকিস্তানের বাজেট মাত্র ১০ বিলিয়ন ডলারের মতো। ফলে আধুনিকায়ন, প্রযুক্তি ও সরঞ্জাম কেনায় ভারত অনেক বেশি সক্ষম।
বিশ্ব সামরিক শক্তির সূচকে (Global Firepower Index ২০২৫), ভারত রয়েছে ৪ নম্বরে এবং পাকিস্তান ৯ নম্বরে অবস্থান করছে।
এই তথ্যগুলো থেকেই বোঝা যায়, সরাসরি সংঘাতে ভারত কিছুটা এগিয়ে থাকলেও, পাকিস্তানের পারমাণবিক সক্ষমতা এবং কৌশলগত ভৌগোলিক অবস্থান যেকোনো যুদ্ধকে জটিল ও ধ্বংসাত্মক করে তুলতে পারে। তাই দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ বাধলে শুধু এই দুটি দেশ নয়, পুরো দক্ষিণ এশিয়াই অস্থির হয়ে উঠবে।
যুদ্ধ মানেই শুধু দুই দেশের ক্ষতি নয়—দক্ষিণ এশিয়ার অস্থিরতা অনিবার্য
ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ মানে শুধুমাত্র সীমান্তে গোলাগুলি নয়—এর অভিঘাত গিয়ে লাগবে বাংলাদেশের বাজারে, নেপালের অর্থনীতিতে, আফগানিস্তানের নিরাপত্তায় এবং এমনকি ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ভূরাজনীতিতেও।
➡️ বাংলাদেশ: রপ্তানি ও আমদানি ব্যহত হবে। ➡️ শ্রীলঙ্কা ও নেপাল: সরবরাহ চেইন ব্যাহত হবে, রাজনৈতিক চাপও বাড়বে। ➡️ আন্তর্জাতিক বাজার: ভারত-পাকিস্তানের উত্তেজনা বিশ্ব বাজারে জ্বালানি ও খাদ্যপণ্যের দামে প্রভাব ফেলবে।
সমাধান কূটনীতিতে, যুদ্ধ নয়
পুলওয়ামা পরবর্তী বালাকোট বিমান হামলা কিংবা কারগিল যুদ্ধ—উভয় দেশের হাজারো প্রাণ হারিয়েছে। এখন আর কোনো সংঘাত নয়, বরং আন্তর্জাতিক কূটনীতিকে সক্রিয় করে শান্তি প্রতিষ্ঠাই হোক চূড়ান্ত লক্ষ্য।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এ মুহূর্তে জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, চীনসহ আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর কূটনৈতিক হস্তক্ষেপ অত্যন্ত জরুরি, না হলে দক্ষিণ এশিয়া একটি ভয়ানক বিপর্যয়ের মুখে পড়তে পারে।
শেষ কথা
কাশ্মীরের রক্তের বদলে যদি রক্ত হয় উত্তরের ভাষা, তবে ইতিহাস শুধু প্রতিশোধেরই পুনরাবৃত্তি ঘটাবে। ভারত ও পাকিস্তান—দুই পরমাণু শক্তিধর দেশকে এবার ভাবতে হবে মানুষ, মাটি, ভবিষ্যতের কথা। যুদ্ধ নয়, শান্তিই হোক এই ভূখণ্ডের নিয়তি।