North News.live

উত্তরবঙ্গের কণ্ঠস্বর

ধান থেকে ড্রাগন ফল: উত্তরবঙ্গের কৃষির রূপান্তরের গল্প

বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গ, বিশেষ করে রাজশাহী, নাটোর ও দিনাজপুর—এই তিনটি জেলা দীর্ঘদিন ধরেই ধান চাষের জন্য বিখ্যাত। একসময় এসব অঞ্চলে ধানই ছিল প্রধান এবং প্রায় একমাত্র ফসল। ধান ছিল কৃষকের জীবিকা, সংসারের ভরসা আর মাটির প্রতি তাদের অকুণ্ঠ বিশ্বাসের প্রতীক। কিন্তু সময় বদলেছে। জলবায়ুর পরিবর্তন, বাজার চাহিদা, বৈচিত্র্যময় খাদ্য সংস্কৃতি এবং প্রযুক্তির অগ্রগতির কারণে বদলে যাচ্ছে উত্তরবঙ্গের কৃষির চেহারা। এখন সেই ধানক্ষেতে গড়ে উঠছে আম, লিচু, ড্রাগন ফল কিংবা ভুট্টার মতো উচ্চমূল্যের ফসলের বাগান। এক ফসলি জমি এখন হয়ে উঠেছে তিন বা চার ফসলি মাঠ।

এই রূপান্তরের পিছনে রয়েছে একাধিক প্রভাবক। প্রথমত, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অনেক এলাকায় খরার প্রকোপ বেড়েছে। ধান চাষে পানি বেশি লাগে, কিন্তু বর্তমানে পানির সহজলভ্যতা অনেকটা কমে গেছে। দ্বিতীয়ত, ধানের বাজারমূল্য স্থিতিশীল নয়, লাভজনকও নয় সবসময়। তাই কৃষকেরা এমন ফসলে ঝুঁকছেন যেগুলোর উৎপাদন খরচ কম, বাজারে চাহিদা বেশি এবং লাভজনক।

উদাহরণ হিসেবে রাজশাহীর চারঘাট এলাকার মিলন হোসেনকে ধরা যাক। তিনি আগে শুধু বোরো ধান চাষ করতেন। লাভ তেমন কিছু হতো না। এরপর স্থানীয় কৃষি অফিসারদের পরামর্শে তিনি তার জমিতে ড্রাগন ফল চাষ শুরু করেন। শুরুতে অনিশ্চয়তা থাকলেও দ্বিতীয় বছর থেকেই তার আয় দ্বিগুণ হয়ে যায়। এখন তার খামারে স্থানীয় তরুণরাও কাজ করছেন। এই বদল কেবল একজনের নয়, এটি একটি বৃহত্তর প্রবণতার অংশ।

উত্তরবঙ্গের কৃষিতে নতুন ধারা এসেছে মাল্টি-ক্রপিং এবং ইন্টিগ্রেটেড ফার্মিং সিস্টেমের মাধ্যমে। এখন একই জমিতে মৌসুমি সবজি, ফল, মাছ এবং হাঁস-মুরগি একসঙ্গে পালন করে কৃষকেরা তাদের আয় বাড়াচ্ছেন বহুগুণে। অনেক কৃষক এখন ইউটিউব দেখে শিখছেন নতুন চাষের পদ্ধতি। তরুণ প্রজন্মের অনেকেই চাকরির জন্য শহরে না গিয়ে গ্রামে ফিরে এসে শুরু করছে কৃষিভিত্তিক স্টার্টআপ।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই পরিবর্তনের ফলে শুধু আয় বাড়ছে না, কৃষকের সম্মানও বাড়ছে। আগে যারা কৃষিকে ‘কামলা কাজ’ ভাবত, তারা এখন নিজেরাই কৃষিতে বিনিয়োগ করছে। অনেক শিক্ষিত যুবক বলছে, “কৃষিই আগামী দিনের স্টার্টআপ।”

তবে এই রূপান্তরের পথও খুব সহজ ছিল না। প্রাথমিকভাবে ব্যাংক ঋণ পাওয়া, প্রশিক্ষণের অভাব, কৃষিপণ্য সংরক্ষণ বা বাজারজাতকরণে জটিলতা ইত্যাদি চ্যালেঞ্জ ছিল। কিন্তু সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে নানা প্রশিক্ষণ ও সহায়তার মাধ্যমে এখন অনেক চাষিই সেসব বাধা কাটিয়ে উঠেছে। কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ, কৃষি প্রযুক্তি মেলা, অ্যাগ্রো-ইউটিউবার এবং স্থানীয় উদ্যোক্তারা মিলে গড়ে তুলেছেন এক ধরনের কৃষিভিত্তিক সম্প্রদায়।

এই কৃষি বিপ্লব কেবল অর্থনীতির নয়, এটি এক সামাজিক আন্দোলনও। এটি এমন এক আন্দোলন যেখানে মাটি, মানুষ ও প্রযুক্তি একসঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। উত্তরবঙ্গের এই পরিবর্তনের গল্প এখন জাতীয় স্তরেও আলোচিত হচ্ছে। অনেক এলাকায় ‘কৃষি ট্যুরিজম’-এর ধারণাও উঠে আসছে—যেখানে পর্যটকেরা এসে শিখছেন চাষাবাদের কৌশল, খাচ্ছেন অর্গানিক খাদ্য আর ফিরে যাচ্ছেন এক টুকরো সবুজ স্মৃতি নিয়ে।

এই গল্প বলে দেয়—পরিবর্তন তখনই সম্ভব, যখন মানুষের চাওয়া, মাটির সম্ভাবনা এবং জ্ঞানের আলো এক হয়ে যায়। উত্তরবঙ্গের কৃষকরা প্রমাণ করেছেন, তারা শুধু উৎপাদন করেন না, তারা গড়ে তোলেন একটি সংস্কৃতি—যা পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে যেতে পারে।

Scroll to Top