নওগাঁ জেলার মাঠজুড়ে এখন সবুজ ভুট্টার সমারোহ। পাতার আড়ালে ঝুলে থাকা কচি কাদি কিছুদিনের মধ্যেই পরিপক্ব ভুট্টায় পরিণত হবে। কোথাও কোথাও দেরিতে লাগানো জমিতে কৃষকরা এখনো পানি সেচ ও পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় পার করছেন। উৎপাদন ব্যয় কম, পরিশ্রমও তুলনামূলকভাবে কম হওয়ায় কৃষকদের কাছে ভুট্টা চাষ ক্রমেই লাভজনক ফসল হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
বিশেষ করে সরকারি প্রণোদনা ও আধুনিক চাষ প্রযুক্তির সহায়তায় নওগাঁর কৃষকরা আগের চেয়ে অনেক বেশি ভুট্টা চাষের দিকে ঝুঁকছেন। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় চলতি বছর রেকর্ড পরিমাণ ফলন ও বাজারে ভালো দাম পাওয়ার প্রত্যাশা করছেন তারা।
লাভজনক ভুট্টা চাষে কৃষকদের ভরসা
ধান ও আলুর তুলনায় ভুট্টা চাষে রোগবালাইয়ের ঝুঁকি কম। সারাবছর চাহিদা থাকার কারণে ভুট্টা বিক্রি করে নিয়মিত আয় করা সম্ভব। ভুট্টা শুধু মানব খাদ্য হিসেবেই নয়, এটি গবাদিপশুর খাদ্য ও শিল্পকারখানার কাঁচামাল হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। উদ্বৃত্ত উৎপাদন থেকে কৃষকরা বাড়তি আয়ের সুযোগ পান এবং সেই অর্থ দিয়ে পরবর্তী মৌসুমের জন্য বিনা ঝামেলায় নতুন ফসলের চাষ করতে পারেন। ফলে নওগাঁর কৃষকরা অন্যান্য ফসলের জায়গায় এখন ভুট্টার আবাদ বাড়াচ্ছেন।
কৃষকদের গল্প: মাঠ থেকে মিলছে সাফল্যের গল্প
ইকরতারা গ্রামের কৃষক ইকবাল হোসেন জানান, তিনি দেড় বিঘা জমিতে ভুট্টা চাষ করেছেন। মাত্র একবার কীটনাশক ব্যবহার করতে হয়েছে, এবং রোগবালাইয়ের তেমন ঝুঁকি ছিল না। প্রতি বিঘা জমিতে আনুমানিক ১৫ হাজার টাকা খরচ হলেও উৎপাদিত ভুট্টা বিক্রি করে ৪৫-৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করার আশা করছেন।
আত্রাই উপজেলার কৃষক আব্দুল করিম, যিনি অন্যের জমি বর্গা নিয়ে চাষাবাদ করেন, এবার প্রথমবারের মতো ভুট্টা চাষ করেছেন। তিনি বলেন, ‘‘সরিষা আর তিলের তুলনায় ভুট্টা চাষ অনেক লাভজনক।’’ তিনি ১৬ হাজার টাকা খরচ করে প্রতি বিঘা জমি থেকে প্রায় ৪০-৪৫ মণ ভুট্টা পাবেন বলে আশাবাদী, যা বাজারে ১ হাজার থেকে ১২০০ টাকা মণ দরে বিক্রি হবে।
তিলাবুদুরী গ্রামের মিনহাজুল বক্স মৃধা জানান, এ বছর তিনি ১০ কাঠা জমিতে ভুট্টা চাষ করেছেন। ফলন ভালো হলে আগামী মৌসুমে জমির পরিমাণ আরও বাড়ানোর পরিকল্পনা করেছেন।
এছাড়া কাশিমপুর গ্রামের কৃষক সোলেমান বলেন, ‘‘ভুট্টার আবাদে ঝুঁকি কম। এ বছর গাছ ভালো হয়েছে, তাই ফলন ও দাম দুটোই ভালো হবে বলে আশা করছি।’’
উৎপাদনে নতুন রেকর্ডের আশায় নওগাঁ
নওগাঁ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আবুল কালাম আজাদ জানান, এ বছর জেলায় ভুট্টা আবাদের পরিমাণ গত বছরের তুলনায় ৪৫০ হেক্টর বেড়ে ৭ হাজার ৮০০ হেক্টর জমিতে পৌঁছেছে। উন্নত জাতের (সানসাইন, সুপারসাইন, তাজমেরি ও মিরাক্কেল) বীজ ব্যবহারের ফলে ফলন ও গুণগত মান দুটোই উন্নত হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
সরকারি প্রণোদনার আওতায় ১ হাজার ৩০০ জন কৃষককে বীজ ও সার সরবরাহ করা হয়েছে। ফলন প্রত্যাশিতভাবে এলে প্রায় ৯৪ হাজার টন ভুট্টা উৎপাদিত হবে, যার বাজার মূল্য প্রায় ২৬০ কোটি টাকারও বেশি।
প্রাকৃতিক পরিবেশ অনুকূল থাকলে এবং বাজার দর স্থিতিশীল থাকলে চলতি মৌসুমে নওগাঁর ভুট্টা চাষে ইতিহাস গড়া সম্ভব। কৃষকের মুখে হাসি ফুটবে এবং ভুট্টার উৎপাদন কেন্দ্র হিসেবে নওগাঁ আরও শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করবে — এমনটাই প্রত্যাশা সবার।