North News.live

উত্তরবঙ্গের কণ্ঠস্বর

“ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার সংগ্রাম: এক ভূখন্ডের রক্তাক্ত ইতিহাস”

এই ভূমিতে এমন কিছু আছে, যার জন্য বেঁচে থাকা যায়…”
— মাহমুদ দারবিশ

ফিলিস্তিনের এই ভূমি শুধুই একটি ভূগোল নয়, এটি তাদের অস্তিত্বের গভীরতম আকাঙ্ক্ষার প্রতিচ্ছবি। এটি স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধরত লাখো মানুষের বুকভরা স্বপ্নের জমিন। যুগের পর যুগ ধরে ফিলিস্তিনি জনগণ নিপীড়ন, দখলদারিত্ব, এবং গণহত্যার বিরুদ্ধে নিজেদের লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের প্রত্যাশা শুধু একটি: স্বাধীনতার সূর্য। দারবিশের কবিতার এই চিরন্তন লাইন যেন ফিলিস্তিনের মানুষের স্বাধীনতা আকাঙ্ক্ষার মূর্ত প্রতীক হয়ে উঠেছে।

ফিলিস্তিনের ইতিহাস দীর্ঘ সংগ্রাম, নিপীড়ন এবং স্বাধীনতার জন্য নিরন্তর লড়াইয়ের এক রক্তমাখা অধ্যায়। এই সংগ্রামের গল্পটি আজকের পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও গভীর মানবিক সংকটগুলোর একটি। ফিলিস্তিনের মাটি কেবল ভূগোলের অংশ নয়, এটি লাখো মুক্তিকামী মানুষের স্বপ্ন, বেঁচে থাকার তাগিদ, এবং স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায় মিশে থাকা এক ইতিহাস।

বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা দিবসের প্রেক্ষিতে আমাদের মনে শোষণ, নির্যাতন ও সংগ্রামের ইতিহাস এখনো গভীরভাবে অঙ্কিত। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়, যা একদিকে যেমন আমাদের স্বাধীনতার যুদ্ধ ছিল, তেমনি অন্যদিকে ছিল মানবাধিকার ও ন্যায়বিচারের সংগ্রাম।

ফিলিস্তিনের বর্তমান সংগ্রামও সেরকমই, কিন্তু তাদের ইতিহাস আরও দীর্ঘ ও ভীতিকর। ফিলিস্তিনের অধিকার রক্ষার সংগ্রাম আজও অব্যাহত, এবং পৃথিবীজুড়ে মানবাধিকার ও স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছেন কোটি কোটি ফিলিস্তিনি। ফিলিস্তিনের আকাশে যুদ্ধের মেঘ—এটি রক্তে রঞ্জিত, এটি অশান্তি এবং অস্থিরতার চিহ্ন। এই অস্থিরতা, এই দুঃখ-কষ্ট, ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা সংগ্রামকে নতুন এক মাত্রায় নিয়ে গেছে। আর আমাদের স্বাধীনতা দিবসে, যখন আমরা নিজেদের স্বাধীনতার কথা স্মরণ করি, তখন কি আমরা ফিলিস্তিনের জনগণের স্বাধীনতার কথা ভাবি? আজ, ফিলিস্তিনের প্রতিটি ঘর, প্রতিটি ভূমি, প্রতিটি পথ এবং প্রতিটি সড়ক তার জীবনের এক অনন্ত সংগ্রামের প্রতীক। ফিলিস্তিনের সংগ্রাম কতটা দীর্ঘ, কষ্টকর, এবং পৃথিবীজুড়ে একটি নিরব সংকেত—এটি আমাদের হৃদয়ে অবিশ্বাস্য বেদনাদায়ক স্মৃতি তৈরি করে।

ইতিহাসের পটভূমি:

ফিলিস্তিনে জায়নবাদী আক্রমণ ১৯৪৮ সালে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইসরাইল প্রতিষ্ঠিত হলে, তাতে ফিলিস্তিনিদের বাসস্থান হিসেবে পরিচিত অঞ্চলটি ভেঙে দিয়ে একটি নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। ইসরাইলের জায়নবাদী প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল ফিলিস্তিনিরা যেখানে বসবাস করতেন, সেখানে তাদের স্থানচ্যুত করা এবং নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা। সেই সময় থেকেই ফিলিস্তিনির উপর শুরু হয় ধারাবাহিক নির্যাতন ও গণহত্যা। একটি ভূখণ্ডের উপর অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ইসরাইল বিভিন্নভাবে ফিলিস্তিনির স্বাভাবিক জীবনযাত্রা বাধাগ্রস্ত করেছে এবং তাদের বসবাসের স্থানগুলোতে হামলা চালিয়েছে।

ইতিহাসের অগ্নি থেকে সংগ্রামের শিখা

১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে, ফিলিস্তিনিদের সংগ্রাম শুরু হয়। তখন থেকে আজ পর্যন্ত, প্রায় ৭৭ বছর ধরে, ফিলিস্তিনিরা তাদের ভূমির জন্য, তাদের জাতির জন্য লড়াই করে আসছে। হাজার হাজার পরিবার হারিয়েছে তাদের প্রিয়জনকে, এবং প্রতি দিন মাটির তলায় রয়ে গেছে তাদের স্বপ্ন। তারা যুদ্ধের বিরুদ্ধে, সামরিক দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে, আর মানবাধিকার হরণের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের প্রতিটি সংগ্রাম যেন এক নতুন অধ্যায়, এক নতুন কিস্তি।

তবে বিশ্বের অপরাধ, বিশ্বের নির্বিকার অবস্থান ফিলিস্তিনের অধিকারের প্রতি এতদিনে এক ভয়ানক নিরবতা সৃষ্টি করেছে। কিছু বড় দেশ যাদের হাতে বিপুল ক্ষমতা, তারা যেন জানেন না, বা জানলেও এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগ গ্রহণে আগ্রহী নয়। গত কয়েক দশকে, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা বারবার ফিলিস্তিনের জন্য বিবৃতি দিয়েছে, কিন্তু কখনোই কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।

নির্যাতন ও গণহত্যার ভয়াবহ চিত্র

ফিলিস্তিনের ওপর ইসরাইলি আক্রমণ শুধু রাজনৈতিক নয়, বরং এটি একটি মানবিক বিপর্যয়ের ক্ষেত্র। ১৯৪৮ সাল থেকে আজ পর্যন্ত ফিলিস্তিনিরা সহ্য করেছে লাখো মানুষের প্রাণহানি, বাড়িঘর ধ্বংস এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ভিত্তি উচ্ছেদ। ২০১৪ সালে গাজার যুদ্ধের ফলে প্রায় ২,২০০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়, যার মধ্যে ছিল ৫০০ শিশু। ২০২১ সালের গাজার ১১ দিনব্যাপী যুদ্ধের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২৫০-৩০০ জন ফিলিস্তিনি নিহত হন, এবং হাজার হাজার মানুষ আহত হয়েছেন। ৭০ বছরেরও বেশি সময় ধরে চলতে থাকা এই সংঘর্ষে প্রায় ১০০,০০০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে এবং লক্ষাধিক ফিলিস্তিনি গুরুতরভাবে আহত হয়েছেন। এর মধ্যে নিরীহ নাগরিক, শিশু, মহিলা এবং বৃদ্ধেরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত।এর সঙ্গে যোগ হয়েছে এক বছর ধরে গাজায় চলা গাজায় ইসরাইলের নারকীয় হত্যাযজ্ঞ। গাজার স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয়ের হিসাবে, ২০২৩ সালের অক্টোবরে যুদ্ধের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত অন্তত ৫০,০২১ ফিলিস্তিনি নিহত এবং ১১৩, ২৭৪ জন আহত হয়েছে। প্রতি বছর ফিলিস্তিনের আকাশে একে একে অন্তহীন বোমা পড়ছে, এবং প্রতিদিন নতুন খবর আসে—আরেকটি ফিলিস্তিনি পরিবার নিঃশেষ হয়ে গেলো। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী মেশিনগান, ট্যাংক,জঙ্গি বিমান দিয়ে প্রতিদিন নিরস্ত্র ফিলিস্তিনিদের ওপর হামলা করা হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে, কবে তারা তাদের অধিকার ফিরে পাবে? এই প্রশ্নটির উত্তর আজও অজানা।

বিশ্বের ভূমিকা: নিষ্ক্রিয়তা ও জায়নবাদীদের সমর্থন

বিশ্ব শক্তিগুলি, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, ইসরাইলের প্রতি তাদের সমর্থন জ্ঞাপন করে আসছে। তাদের সক্রিয় সমর্থনের কারণে ইসরাইল ফিলিস্তিনের উপর অগ্নিপরীক্ষা চালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে, ফলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ফিলিস্তিনের পক্ষে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। জাতিসংঘের অকার্যকর ভূমিকা, এবং মানবাধিকার সংস্থা গুলোর নিষ্ক্রিয়তা ফিলিস্তিনিদের কষ্ট বাড়িয়েছে। এই অবস্থার মধ্যে, ফিলিস্তিনের জনগণ নিজেদের সংগ্রাম অব্যাহত রেখেছে, তবে বৈশ্বিক সমর্থন এবং কার্যকর পদক্ষেপের অভাব তাদের স্বাধীনতা অর্জনকে আরও কঠিন করে তুলেছে।

স্বাধীনতা অর্জনের পথ: আশা কি আছে?

স্বাধীনতার জন্য ফিলিস্তিনের সংগ্রাম একদিন সফল হবে, এমন দৃঢ় বিশ্বাস ছিল অনেকের। কিন্তু যুদ্ধের দিনগুলির মধ্যে একটি প্রশ্ন বারবার উঠে আসে—”এভাবে কি স্বাধীনতা সম্ভব?” তবে, ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিলে, আমরা দেখতে পাই যে স্বাধীনতা অর্জন কখনোই একটি সোজা পথ নয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মতোই, ফিলিস্তিনিরাও এই সংগ্রাম জয়ী হতে পারে, তবে তা সময়সাপেক্ষ এবং সাহসী পদক্ষেপের দাবী রাখে।

ফিলিস্তিনিদের সংগ্রাম, তাদের প্রতি বিশ্বের সমর্থন, এবং মুসলিম বিশ্বের একযোগ প্রচেষ্টা এই আন্দোলনকে শক্তিশালী করতে পারে। এর পাশাপাশি, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য শক্তিধর দেশগুলোর দায়বদ্ধতা এবং সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে। যে দিন আন্তর্জাতিক সমাজ একত্রিত হয়ে ফিলিস্তিনের স্বীকৃত অধিকার এবং স্বাধীনতা নিয়ে কথা বলবে, সে দিন সম্ভব হবে শান্তি প্রতিষ্ঠা।

ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা:

ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা অর্জন একটি দীর্ঘ ও কঠিন প্রক্রিয়া। তবে এ ক্ষেত্রে কিছু কূটনৈতিক এবং রাজনৈতিক পদক্ষেপ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

জাতিসংঘের মাধ্যমে স্বাধীনতা স্বীকৃতি: বিশ্বের দেশগুলোর সম্মিলিত উদ্যোগে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে পূর্ণ সদস্য হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান। এটি আন্তর্জাতিকভাবে ফিলিস্তিনিদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারে।

বিশ্বের গণমাধ্যম এবং বেসরকারি সংগঠনের ভূমিকা: আন্তর্জাতিক মিডিয়া ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোর আরও কার্যকর ভূমিকা, যাতে ফিলিস্তিনিদের পরিস্থিতি আন্তর্জাতিক জনগণের কাছে আরো স্পষ্ট হয় এবং সমর্থন বৃদ্ধি পায়।

বৈশ্বিক সমর্থন এবং সংহতি: পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ও সংগঠনকে একত্রিত হয়ে ফিলিস্তিনের অধিকারের জন্য কূটনৈতিক চাপ সৃষ্টি করতে হবে, যাতে ইসরাইলের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ানো যায়।

ফিলিস্তিনিদের আত্মসংগঠিত সংগ্রাম: ফিলিস্তিনিরা তাদের আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক বৃদ্ধি করে, এবং বিভিন্ন অঙ্গনে তাদের স্বাধীনতা সংগ্রামকে ত্বরান্বিত করতে পারে।

বিশ্বের কি করণীয়?

বিশ্বের সম্প্রদায় এখন আরও সক্রিয়ভাবে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার পক্ষে কাজ করতে পারে। এটি একদিকে যেমন মানবাধিকার রক্ষার বিষয়, তেমনি একটি ন্যায্য ও শান্তিপূর্ণ পৃথিবী প্রতিষ্ঠার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত ফিলিস্তিনিদের অধিকার পূর্ণভাবে রক্ষা করা এবং তাদের সংগ্রামে সমর্থন জানানো।

ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা একটি সংগ্রামী যাত্রা, তবে এই সংগ্রাম একদিন সফল হবে। স্বাধীনতা, মানবাধিকার, এবং শান্তির জন্য ফিলিস্তিনিরা অবিরাম লড়াই করে যাচ্ছেন, এবং বিশ্বকেও তাদের পাশে দাঁড়িয়ে এই সংগ্রামে সহযোগিতা করতে হবে।বিশ্ব যখন মানবাধিকারের প্রতি দৃঢ় অবস্থান নিবে, তখনই ফিলিস্তিনের জনগণ তাদের স্বাধীনতা অর্জন করতে সক্ষম হবে। এটি একদিন বিশ্বকে একটি নতুন, ন্যায্য ও শান্তিপূর্ণ সমাজ উপহার দিতে পারবে।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট: ফিলিস্তিনির স্বাধীনতার জন্য আমাদের ভূমিকা

আজ ২৬ মার্চ, আমাদের মহান স্বাধীনতা দিবস। এই দিনটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, স্বাধীনতা শুধু এক দেশের নয়, বরং এটি একটি মানবিক অধিকার। আমরা যারা বাংলাদেশের নাগরিক, তাদের উচিত ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করা, তাদের পাশে দাঁড়ানো। বাংলাদেশের সরকারের পক্ষ থেকে ফিলিস্তিনের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আন্তর্জাতিক মঞ্চে আরও সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করা প্রয়োজন।

যেহেতু স্বাধীনতা সংগ্রাম কখনোই সহজ পথের পথিক নয়, আমাদের প্রয়োজন একত্রিতভাবে ফিলিস্তিনির অধিকারের পক্ষে কণ্ঠ তুলে ধরতে। পৃথিবী যখন নিরব, তখন আমাদের সবার দায়বদ্ধতা হতে হবে ফিলিস্তিনের সংগ্রামকে সমর্থন জানানো, এবং তাদের স্বাধীনতার জন্য সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া।

ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা, মানবাধিকারের জয়!

Scroll to Top