“হামজা চৌধুরী কি বদলে দেবেন বাংলাদেশের ফুটবলের ভাগ্য?”
বাংলাদেশের ফুটবল দীর্ঘদিন ধরেই আন্তর্জাতিক মঞ্চে ধারাবাহিকতার অভাব, অবকাঠামোগত দুর্বলতা এবং প্রতিভাবান খেলোয়াড়ের সংকটে ভুগছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে নতুন আলো দেখিয়েছেন একজন ফুটবলার—হামজা চৌধুরী। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এই ব্রিটিশ মিডফিল্ডার, যিনি প্রিমিয়ার লিগের ক্লাব লেস্টার সিটির হয়ে খেলে ইতোমধ্যেই নিজের জাত চিনিয়েছেন, এখন বাংলাদেশের ফুটবলের জন্য আশার বাতিঘর হয়ে উঠেছেন। প্রশ্ন হচ্ছে, তিনি কি সত্যিই বাংলাদেশের ফুটবলকে বদলে দিতে পারবেন?
হামজা চৌধুরীর সবচেয়ে বড় শক্তি হলো তার ইউরোপিয়ান ফুটবলে অর্জিত অভিজ্ঞতা। প্রিমিয়ার লিগের মতো বিশ্বের অন্যতম কঠিন লিগে খেলার অভিজ্ঞতা তার ফুটবল দক্ষতা ও কৌশলগত বুদ্ধিমত্তাকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। মাঠে তার ট্যাকটিক্যাল ডিফেন্স, বল কন্ট্রোল এবং মাঝমাঠ নিয়ন্ত্রণ করার দক্ষতা বাংলাদেশের ফুটবলে নতুন মাত্রা যোগ করতে পারে। বাংলাদেশের বর্তমান দলে একজন দক্ষ মিডফিল্ডারের অভাব বহুদিন ধরেই অনুভূত হচ্ছিল। হামজা সেই শূন্যতা পূরণ করতে পারেন।
২৫ মার্চ ২০২৫ তারিখে শিলংয়ে অনুষ্ঠিত এশিয়ান কাপ বাছাইপর্বের ম্যাচে ভারতের বিপক্ষে গোলশূন্য ড্রয়ে অভিষেক ঘটে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে খেলা মিডফিল্ডার হামজা চৌধুরীর। এই ম্যাচে তার পারফরম্যান্স ছিল উল্লেখযোগ্য এবং প্রশংসনীয়।
ম্যাচের শুরু থেকেই হামজা মাঝমাঠে তার উপস্থিতি দৃঢ়ভাবে জানান দেন। তার ট্যাকটিক্যাল সচেতনতা ও বল কন্ট্রোলের দক্ষতা ভারতের আক্রমণভাগকে বারবার ব্যাহত করে। বিশেষ করে, ভারতের অভিজ্ঞ ফরোয়ার্ড সুনীল ছেত্রীকে মার্কিং করে তিনি কার্যকরভাবে নিষ্ক্রিয় করে রাখেন, ফলে ছেত্রী উল্লেখযোগ্য কোনো সুযোগ সৃষ্টি করতে পারেননি।
হামজার রক্ষণাত্মক মিডফিল্ডারের ভূমিকা পালন করলেও, তিনি মাঠজুড়ে সক্রিয় ছিলেন। বল দখলের লড়াইয়ে তার স্লাইডিং ট্যাকেল ও পাস কাটা দক্ষতা ভারতের আক্রমণ নস্যাৎ করতে সহায়তা করে। এছাড়া, কর্নার কিক নেওয়া ও আক্রমণ গঠনে তার অবদান বাংলাদেশের খেলায় নতুন মাত্রা যোগ করে।
বাংলাদেশ দলের আক্রমণভাগ বেশ কয়েকটি সুযোগ তৈরি করলেও গোল করতে ব্যর্থ হয়। তবে, হামজার উপস্থিতি দলের খেলায় গতি ও সৃজনশীলতা বাড়িয়েছে, যা ভবিষ্যতে বাংলাদেশের ফুটবলের জন্য ইতিবাচক ইঙ্গিত বহন করে।
হামজা চৌধুরী শুধু মাঠে তার পারফরম্যান্স দিয়েই নয়, তরুণ প্রজন্মের ফুটবলপ্রেমীদের জন্য অনুপ্রেরণার প্রতীক হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারেন। তিনি এমন একজন খেলোয়াড়, যিনি ব্রিটিশ ফুটবলের মূলধারায় জায়গা করে নিয়েছেন, এবং তার বাংলাদেশি শিকড়কে অস্বীকার না করে গর্বের সাথে সামনে এনেছেন। তার এই পরিচয় বাংলাদেশের তরুণদেরও উৎসাহিত করতে পারে, যারা বিদেশি লিগে খেলার স্বপ্ন দেখেন।
তবে প্রশ্ন হলো, শুধু হামজার উপস্থিতি কি বাংলাদেশের ফুটবলকে বদলে দিতে পারবে? একজন খেলোয়াড়ের ওপর পুরো দল বা দেশের ফুটবলের পরিবর্তন নির্ভর করা বাস্তবসম্মত নয়। তার উপস্থিতি যতই গুরুত্বপূর্ণ হোক না কেন, বাংলাদেশের ফুটবলের দীর্ঘমেয়াদি উন্নতির জন্য প্রয়োজন অবকাঠামোগত উন্নয়ন, কোচিং ব্যবস্থার আধুনিকায়ন এবং কিশোর ফুটবল একাডেমিগুলোর কার্যকর ভূমিকা। হামজা চৌধুরীর মতো অভিজ্ঞ খেলোয়াড়েরা যদি বাংলাদেশের তরুণ প্রতিভা খুঁজে বের করার এবং তাদের উন্নত প্রশিক্ষণ দেওয়ার প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত হন, তাহলে পরিবর্তন আরও টেকসই হবে।
বাংলাদেশ ফুটবলের সামগ্রিক উন্নতির জন্য হামজার মতো খেলোয়াড়ের পাশাপাশি ফেডারেশনকে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। দেশের লিগগুলোকে আরও প্রতিযোগিতামূলক করতে হবে, যাতে স্থানীয় খেলোয়াড়রা নিয়মিতভাবে উচ্চমানের ফুটবলে অংশ নিতে পারে। হামজার উপস্থিতি স্থানীয় খেলোয়াড়দের মানসিকতা ও কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গি উন্নত করতে সাহায্য করবে, তবে সেটা টেকসই করতে ফেডারেশনের দায়িত্বশীল ভূমিকা অপরিহার্য।
হামজা চৌধুরী নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের ফুটবলে আশার নতুন দ্বার উন্মোচন করেছেন। তবে তার একার উপর দেশের ফুটবলের ভবিষ্যৎ নির্ভর করা ঠিক হবে না। তার অভিজ্ঞতা ও আন্তর্জাতিক মানের পারফরম্যান্স দেশের ফুটবলের মানোন্নয়নে বড় ভূমিকা রাখবে, কিন্তু সঠিক পরিকল্পনা, অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং স্থানীয় প্রতিভা উন্নয়নের সমন্বয় ছাড়া দীর্ঘমেয়াদি পরিবর্তন সম্ভব নয়। তবে হামজার আগমন যে বাংলাদেশের ফুটবলে ইতিবাচক পরিবর্তনের সূচনা করেছে, সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না।
শুধু সময়ই বলে দেবে, হামজা চৌধুরী বাংলাদেশের ফুটবলের জন্য ইতিহাস বদলে দেওয়া এক নতুন অধ্যায়ের নায়ক হয়ে উঠবেন কি না। তবে তার উপস্থিতি ইতোমধ্যেই স্বপ্ন দেখাচ্ছে কোটি ফুটবলপ্রেমীকে। আর ফুটবল তো স্বপ্নেরই খেলা।