এ বছর বাংলাদেশের আম উৎপাদন ও রপ্তানিতে এক ঐতিহাসিক মাইলফলক স্পর্শ করতে চলেছে। কৃষি বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মতে, গ্রীষ্মকালীন রাজকীয় ফল আমের উৎপাদন এবং আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানির দিক থেকে চলতি বছরটি হতে যাচ্ছে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এ বছর প্রায় ২ লাখ ৫ হাজার ৩৪ হেক্টর জমিতে আমের চাষ হচ্ছে এবং লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে প্রায় ২৭ লাখ মেট্রিক টন উৎপাদন। শুধু দেশেই নয়, আম রপ্তানিতেও রেকর্ড গড়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। প্রায় ৫ হাজার মেট্রিক টন আম বিদেশে রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
চীনে প্রথমবার আম রপ্তানি এ বছর বাংলাদেশের আম প্রথমবারের মতো চীনের বাজারে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে আম রপ্তানির বিষয়ে সমঝোতা স্মারক (MoU) স্বাক্ষরিত হয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ‘রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদন প্রকল্প’-এর প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ আরিফুর রহমান বাসসকে জানান, চীনে রপ্তানির জন্য প্রয়োজনীয় হট ওয়াটার ট্রিটমেন্ট, প্যাকেজিং ও অন্যান্য মান নিয়ন্ত্রণ পরীক্ষায় বাংলাদেশের আম ইতোমধ্যে অনুমোদন পেয়েছে।
চীনের জেনারেল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অব কাস্টমস (GACC) গত বছরের জুলাইয়ে বাংলাদেশকে আম রপ্তানির জন্য নিবন্ধন প্রদান করেছে। বর্তমানে চীনের আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশের আমের গুণগতমান যাচাই করছেন। আশা করা হচ্ছে, জুন মাস থেকেই চীনে বাণিজ্যিকভাবে আম রপ্তানি শুরু হবে।
উৎপাদন ও রপ্তানির ইতিবাচক ধারা ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশে আমের উৎপাদন হয়েছিল ২৩ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন, যা পরবর্তী বছরগুলোতে আরও বেড়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে উৎপাদন দাঁড়ায় ২৭ লাখ ৭ হাজার মেট্রিক টন। যদিও ২০২৩-২৪ অর্থবছরে কিছুটা কমে ২৫ লাখ ৮ হাজার ৯৭৩ মেট্রিক টনে দাঁড়ায়।
রপ্তানির দিক থেকেও বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে যেখানে মাত্র ৩০৯ মেট্রিক টন আম রপ্তানি হয়েছিল, সেখানে ২০২১-২২ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১৭৫৭ মেট্রিক টনে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে আরও উন্নতি হয়ে রপ্তানি হয় ৩১ মেট্রিক টন। তবে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে রপ্তানিতে কিছুটা ভাটা পড়ে এবং মাত্র ১৩২১ মেট্রিক টন আম রপ্তানি হয়।
বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের অবস্থান বর্তমানে আম উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বের সপ্তম বৃহত্তম দেশ। বাংলাদেশের আম যুক্তরাজ্য, ইতালি, ফ্রান্স, কানাডা, সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, সুইডেন, জার্মানি ও নেপালসহ বিশ্বের অন্তত ৩৮টি দেশে রপ্তানি হয়।
বিশ্বে আম রপ্তানিতে শীর্ষস্থানীয় দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে মেক্সিকো, ভারত, থাইল্যান্ড, পাকিস্তান, ব্রাজিল, পেরু ও ইকুয়েডর। এদের মধ্যে মেক্সিকো বছরে প্রায় ৪ লাখ ২১ হাজার ৬৩৬ টন আম রপ্তানি করে বিশ্ব রপ্তানি বাজারে শীর্ষস্থান ধরে রেখেছে।
প্রধান আম উৎপাদনকারী অঞ্চল বাংলাদেশের মধ্যে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, সাতক্ষীরা, নওগাঁ, দিনাজপুর, কুষ্টিয়া এবং যশোর অঞ্চলগুলো সবচেয়ে বেশি আম উৎপাদন করে। সাতক্ষীরার গোপালভোগ আম দিয়ে আগামী ৫ মে থেকে এবারের মৌসুমের আম সংগ্রহ শুরু হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
দেশীয় আমের বৈচিত্র্য বাংলাদেশে ফজলি, ল্যাংড়া, হিমসাগর, গোপালভোগ, ক্ষীরশাপাত, আম্রপালি, মল্লিকা, সুবর্ণরেখা, মিশরিদানা, বারি আম (১ থেকে ৯) সহ অসংখ্য উন্নত জাতের আম উৎপাদিত হয়। এই বৈচিত্র্য বাংলাদেশের আমকে আন্তর্জাতিক বাজারে আলাদা পরিচিতি দিয়েছে।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক সাজ্জাদ হোসেন মজুমদার জানিয়েছেন, আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে এ বছর আমের উৎপাদন ও রপ্তানি উভয় ক্ষেত্রেই পূর্বের সকল রেকর্ড ভেঙে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি হবে। নতুন করে চীনের বাজারে প্রবেশ বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য একটি বড় অর্জন হবে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
বাংলাদেশের মিষ্টি ও রসালো আম বিশ্ববাজারে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করবে—এ প্রত্যাশায় তাকিয়ে আছে গোটা জাতি।