রাজশাহীতে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে নদী গবেষক ও ফারাক্কা লং মার্চ উদযাপন কমিটির আহ্বায়ক মাহবুব সিদ্দিকী জানান, ভারতের ফারাক্কা ব্যারাজ নির্মাণের ফলে বাংলাদেশে অন্তত ৬ কোটি মানুষ সরাসরি সেচ সংকটে পড়েছেন। এর মধ্যে উত্তরের বরেন্দ্র অঞ্চলসহ উত্তরাঞ্চলের ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা প্রায় ২ কোটি, আর দক্ষিণ ও মধ্যাঞ্চলের ৪ কোটি মানুষ পানির ঘাটতির কারণে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন।
বরেন্দ্র অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানি সংকট
ফারাক্কা ব্যারাজের প্রভাব থেকে গঙ্গা-কপোতাক্ষ প্রকল্পের ৬৫ শতাংশ এলাকায় সেচ কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। বরেন্দ্র অঞ্চলের গভীর নলকূপ ১০০% অকেজো এবং ২১% অগভীর নলকূপ কার্যহীন হয়ে পড়েছে। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নামার কারণে হস্তচালিত পাম্পগুলোও কাজে আসছে না। এছাড়া উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে নলকূপের পানিতে আর্সেনিকের উপস্থিতি বেড়ে যাওয়ায় অনেক অঞ্চলের পানি পানের অযোগ্য হয়ে পড়েছে।
দক্ষিণাঞ্চলের লবণাক্ততা বৃদ্ধি ও পরিবেশ সংকট
উজানের পানি কমে যাওয়ায় দক্ষিণাঞ্চলে লবণাক্ততা বেড়েছে, যার ফলে খুলনা ও সাতক্ষীরা অঞ্চলে ধান উৎপাদন কমেছে এবং সুন্দরবনের প্রাণবৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে। জমির উর্বরতা কমে যাওয়ায় কৃষি বিপর্যয় শুরু হয়েছে।
পদ্মা নদীর সংকট
গত ৪০ বছরে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে পদ্মা নদীর আয়তন কমেছে ৫০%, গভীরতা কমেছে প্রায় ১৮% এবং পানির প্রবাহ কমেছে ২৬%। এক বছরের মধ্যে পদ্মার পানি প্রবাহ ৯০,৭৩০ কিউসেক থেকে কমে ৭৫,৪০৯ কিউসেকে নেমে এসেছে। এই সংকটের ফলে পদ্মার কিছু বিলুপ্তপ্রায় মাছ ও জলজ প্রাণী যেমন ডলফিন, ঘড়িয়াল ইত্যাদি বিলুপ্তির পথে।
ফারাক্কা চুক্তি ও ভারতীয় একতরফা পানি ব্যবস্থাপনা
১৯৭৭ সালের পানি বণ্টন চুক্তিতে শুষ্ক মৌসুমে নির্দিষ্ট পরিমাণ পানি পেতে বাংলাদেশ গ্যারান্টি পেয়েছিল। তবে ১৯৮২ সালে চুক্তি নবায়নের পরিবর্তে গ্যারান্টি ক্লজ বাদ দেয়া হয়। ভারতের একতরফাভাবে গঙ্গার পানি ব্যবহার এবং উজানে প্রায় ৪০০ পয়েন্টে পানি প্রত্যাহারের কারণে বাংলাদেশের ভাটির অঞ্চল পানিহীন হয়ে পড়েছে।
সমাধানে সুপারিশ ও আহ্বান
সংবাদ সম্মেলনে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ উঠে আসে, যেমন:
-
১৯৯৬ সালের গঙ্গা চুক্তি বাস্তবায়ন যাচাই ও জনগণকে তথ্য সরবরাহ
-
২০২৬ সালের চুক্তি নবায়নের আগে পূর্ণ পর্যালোচনা
-
গ্যারান্টি ক্লজ পুনরায় সংযুক্তি
-
যৌথ নদী কমিশনে নেপালকে অন্তর্ভুক্তি
-
আন্তর্জাতিক আদালতে যাওয়ার প্রস্তুতি
-
আঞ্চলিক পানি ফোরাম গঠন
মাহবুব সিদ্দিকী বলেন, “ফারাক্কা সমস্যা শুধু পানি সংকট নয়, এটি একটি আর্থ-সামাজিক, পরিবেশগত ও ভূ-রাজনৈতিক ইস্যু। তাই এর সমাধানে প্রয়োজন মজবুত জাতীয় ঐক্য, সক্রিয় কূটনীতি ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা।”
সংবাদ সম্মেলনটি আয়োজন করে ‘ঐতিহাসিক ফারাক্কা লং মার্চ ৪৯তম বর্ষপূর্তি উদযাপন কমিটি’। এতে অংশগ্রহণ করেন প্রবীণ রাজনীতিবিদ মাহমুদ জামাল কাদেরীসহ অন্যান্য সংশ্লিষ্টরা।