ভূরাজনীতির দাবার ছকে কখনো কখনো এমন চাল দিতে হয়, যা আগেই কেউ কল্পনাও করেনি। দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে সম্প্রতি তেমন এক চমকপ্রদ পদক্ষেপ নিয়েছে ভারত। ২০২১ সালে তালিবানের আফগানিস্তানে পুনরুত্থানের পর এই প্রথম, নয়াদিল্লি এবং কাবুলের মধ্যে সর্বোচ্চ রাজনৈতিক পর্যায়ে সরাসরি যোগাযোগ হলো।
সম্প্রতি ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস. জয়শঙ্কর ফোনে কথা বলেন আফগানিস্তানের অন্তর্বর্তী পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাওলানা আমির খান মুত্তাকির সঙ্গে। এই কথোপকথনের অন্যতম তাৎপর্যপূর্ণ দিক ছিল পহেলগাম সন্ত্রাসী হামলার নিন্দা জানানোর জন্য জয়শঙ্করের তরফ থেকে মুত্তাকিকে ধন্যবাদ জানানো। ২২ এপ্রিলের ওই হামলায় ২৬ জন নিহত হন এবং তার পরই ভারত ‘অপারেশন সিন্ধুর’ চালায়, যা মূলত পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত এলাকা লক্ষ্য করে পরিচালিত হয়।
জয়শঙ্কর আরও বলেন, ভারত ও আফগানিস্তানের মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে সম্প্রতি ছড়ানো ‘ভিত্তিহীন গুজব’ প্রতিহত করায় তিনি তালিবান সরকারের ভূয়সী প্রশংসা করেন। পাকিস্তানের একটি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারত নাকি তালিবানকে দিয়ে পহেলগাম হামলা করিয়ে ‘ফলস ফ্ল্যাগ অপারেশন’ চালিয়েছে—এই দাবি তালিবান কর্তৃপক্ষ সরাসরি নাকচ করে দেয়।
এই ফোনালাপের মাধ্যমে ভারতের পক্ষ থেকে একটি স্পষ্ট বার্তা দেওয়া হলো: তালিবান এখন কেবল আড়াল থেকে নয়, প্রকাশ্যেও নয়াদিল্লির কূটনৈতিক আলোচনায় অংশীদার হতে পারে।
অতীতের তিক্ততা, বর্তমানের প্রয়োজনে ধুলোচাপা
এই যোগাযোগের পেছনে রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাস। আফগানিস্তানের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক বহু শতাব্দী পুরোনো—সংস্কৃতি, ধর্ম, ইতিহাস এবং ভূরাজনৈতিক স্বার্থে গভীরভাবে জড়ানো। মহাভারতের গান্ধার থেকে শুরু করে ব্রিটিশদের ‘গ্রেট গেম’-এ আফগানিস্তানকে বাফার স্টেট হিসেবে ব্যবহার পর্যন্ত—এই দুই ভূখণ্ডের সম্পর্ক জটিল এবং বহুমাত্রিক।
তবে তালিবানের উত্থানের পর থেকে ভারত-আফগান সম্পর্ক দীর্ঘদিন ধরেই প্রতিকূল ছিল। বিশেষত ১৯৯৯ সালের কান্দাহার বিমান ছিনতাইয়ের ঘটনায়, যখন তালিবানের ছত্রছায়ায় অপহরণকারীদের সঙ্গে ভারতকে সমঝোতা করতে বাধ্য হতে হয়, তখন সম্পর্ক তলানিতে ঠেকে।
২০২১ সালে তালিবান ফের ক্ষমতায় এলে ভারত প্রথমে সতর্ক অবস্থান নেয়—কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থগিত রেখে সীমিত মানবিক সহায়তার পথে হাঁটে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দৃশ্যপট বদলেছে।
২০২৫ সালের জানুয়ারিতে দুবাইয়ে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিশ্রির সঙ্গে তালিবান পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠক এবং এখন জয়শঙ্করের সরাসরি যোগাযোগ—এই দুই ঘটনা বলছে, ভারত তার অবস্থান পাল্টাচ্ছে। এটি এখন আর নিছক ‘ধীরে চলো’ নীতি নয়, বরং এক কৌশলগত উদ্যোগ।
তালিবান-পাকিস্তান টানাপোড়েন: ভারতের জন্য সুযোগ
এই উষ্ণতার অন্যতম কারণ তালিবান ও পাকিস্তানের মধ্যকার ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা। একসময় ইসলামাবাদ ছিল তালিবানের ঘনিষ্ঠ মিত্র। কিন্তু এখন সেই সম্পর্কে ফাটল ধরেছে। পাকিস্তান বারবার অভিযোগ করছে, টিটিপি (তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান) আফগান ভূখণ্ড ব্যবহার করে পাকিস্তানে হামলা চালাচ্ছে। এমনকি ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে পাকিস্তান আফগানিস্তানের পাকতিকা প্রদেশে বিমান হামলাও চালায়।
তালিবান সরকার এসব অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছে এবং এর বিপরীতে, ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে আগ্রহ দেখিয়েছে। তালিবানও বুঝছে—আন্তর্জাতিক মঞ্চে একঘরে হয়ে পড়লে বিকল্প শক্তির প্রয়োজন পড়ে, আর সেখানে ভারতের মতো আঞ্চলিক পরাশক্তি একটি সম্ভাব্য সঙ্গী।
কৌশলগত বিনিয়োগ হিসেবে তালিবান?
তালিবান সরকারের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত, এই সত্য ভারত অস্বীকার করছে না। তবে তবুও নয়াদিল্লি বুঝছে—আফগানিস্তানকে সম্পূর্ণভাবে ছেড়ে দেওয়া মানেই সেখানে পাকিস্তান ও চীনের প্রভাব বৃদ্ধির পথ প্রশস্ত করা। ভারত চায়, আফগানিস্তান তার বিকল্প পথ হিসেবেও নয়াদিল্লিকে দেখুক।
বিশেষত ইরানের চাবাহার বন্দর ঘিরে যে বাণিজ্য সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, তাতে তালিবানও আগ্রহী। পাকিস্তানের সঙ্গে স্থলসীমান্ত বন্ধ থাকায় আফগান ব্যবসায়ীরা ভারতের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য এই বন্দরের ওপর নির্ভর করতে আগ্রহী হয়ে উঠেছে।
উপসংহার: শত্রুর শত্রু কখনো কখনো বন্ধু হয়ে ওঠে
আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে কোনো দেশের স্থায়ী বন্ধু বা শত্রু নেই—থাকে কেবল স্বার্থ। ভারতের এই নতুন কূটনৈতিক ধারা সেটাই দেখাচ্ছে। তালিবান বিশ্ব রাজনীতিতে অস্থিরতার প্রতীক হলেও, দক্ষিণ এশিয়ার শক্তির ভারসাম্যে এক অপ্রত্যাশিত চাল হয়ে উঠতে পারে তারা।
ভারতের এই পদক্ষেপ কেবল কাবুল নয়, ইসলামাবাদ এবং বেইজিংয়েও এক কড়া বার্তা—নতুন দক্ষিণ এশিয়ায় ভূরাজনীতির নিয়মগুলো বদলাচ্ছে, এবং ভারত সেই বদলের কেন্দ্রে থাকতে চায়।